যৌতুক প্রথাকে বন্ধ করতে না পারলেও ঘৃণা করতে তো পারবো…!!!


লিখেছেন – শেখ ফরিদ আলম

একটা খবর দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেল। একজন মহিলাকে বিয়ের পর যৌতুকের জন্য এতটা অত্যাচার করা হয়েছিল যে, সে বাধ্য হয়ে নিজের কিডনি বিক্রি করে টাকা দিয়েছিল শ্বশুর বাড়িতে। কিন্তু তাতেও তাদের মন ভরেনি। অত্যাচারের মাত্রাও কমেনি। তাই বাধ্য হয়ে নিজের গা’য়ে আগুন দিয়েছেন সেই মহিলা। বর্তমানে যৌতুকের নামে কত নারীকে স্বাভাবিক সুখ থেকে বঞ্চিত করা হয়, অকারণে অত্যাচার করা হয়, পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়, আত্মহত্যা করার জন্য প্ররোচনা দেওয়া হয়, ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তার হিসেব করা কঠিন। এটা অনেক বড় সমস্যা এবং নারীদের সাথে চরম অন্যায়। সবথেকে খারাপ লাগে যখন দেখি, মানুষ পণ দেওয়া নেওয়াকে খারাপই মনে করেনা। এটাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। পণ আর কেউ চোরের মতো চাই না, বুক ফুলিয়ে চাই। কত বেশি হারামের টাকা ঘরে তুলতে পারলাম তারও প্রতিযোগিতা চলে।

শুধু যে ছেলেপক্ষ যৌতুক চাই বলে দিতে হয় তা নয়। বর্তমানে সমাজে অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে যৌতুক প্রথা। মেয়েপক্ষও এটাকে নিজেদের জন্য ফরয মনে করে ফেলেছেন। যেন দিতেই হবে, না দেওয়াটা অন্যায়। অনেকে আবার বলেন, আমাদের কোন ডিমান্ড নাই। শখ করে যা দেওয়ার দেবেন। শখ করে দিতে পারবেনা এমন বলছিনা কিন্তু শখটাও এমন হওয়া উচিত না যা মেয়ের বাবার মেরুদন্ডই ভেঙ্গে ফেলে। ধারদেনায় ডুবিয়ে ফেলে। কত পরিবারকেই মেয়ের বিয়ে দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে যেতে দেখেছি। জমি জায়গা বিক্রি করে, চেয়ে, চাঁদা তুলে বিয়ে দিতেও দেখেছি অনেককেই। অথচ, এমন হওয়া উচিত ছিলনা। যৌতুকের কারণে বিয়ে সমাজে কঠিন হয়ে গেছে। আবার এমন লোকও দেখা যায় যারা মেয়ের বিয়েতে যা দিয়েছে তার থেকেও বেশি ডিমান্ড করে ছেলের বিয়েতে। আর মেয়েকে দিয়ে থাকলে ছেলের জন্য চাইতে কোন রকমের লজ্জা বা সংকোচও করেনা।

আমাদের সমাজে নারী কেন্দ্রিক আরেকটা বড় সমস্যা হল কণ্যা ভ্রুণহত্যা। এই অন্যায় কাজ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লিনিক গুলোতে হচ্ছে অহরহ! আর এই ভ্রুণহত্যার জন্যও অনেকটা দায়ি যৌতুক। মানুষ কণ্যা সন্তান নিতে চাইছেনা, হলে অসন্তষ্ট হচ্ছে বা হওয়ার আগে মেরে ফেলছে এটা তো অনেকটা যৌতুকের ভয়েই। জাহিলিয়াত যুগে যেমন কণ্যা হলে মাটিতে পুঁতে ফেলত আর তেমন হচ্ছেনা, ডাক্তারদের কল্যাণে ডাস্টবিন বা আবর্জনায় পড়ে থাকছে সেই ছোট্ট শিশুটির লাশ!!

 ইসলামে যৌতুক নেওয়া নিষিদ্ধ। উলটো স্ত্রীকে মোহর দেওয়া আবশ্যকীয়। ফুলশয্যা হওয়ার পূর্বে তা সম্পূর্ণরুপে অথবা আংশিকরুপে আদায় দেওয়া জরুরি। যেটা বাকী থাকবে সেটা ঋণ। তা আদায় করার নিয়ত রাখতে হবে। বাসর রাতে স্ত্রীর কাছে মাফ চেয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। মহান আল্লাহ বলেন,‘তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর সন্তুষ্ট মনে দিয়ে দাও, পরে তারা খুশী মনে ওর কিয়দংশ ছেড়ে দিলে, তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করো’(সুরা নিসা/৪)। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সা. বলেছেন,‘যে সকল শর্ত তোমাদের জন্য পালন করা জরুরী, তন্মধ্যে সবচাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল তাই.. যার দ্বারা তোমরা (পরস্পরের) গোপনাঙ্গ হালাল করে থাকো’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত/৩১৪৩)। আর দেনমোহর ঐ শ্রেণীর একটি শর্ত। যা আদায় করা জরুরি। যারা স্ত্রীকে মোহর না দিয়ে ধোঁকা দেয় তাদের সম্পর্কে নবী সা. বলেছেন,‘যে কোন ব্যক্তি কোন মহিলাকে কম-বেশী মোহরের বিনিময়ে বিবাহ করেছে, মনে মনে তার হক তাকে আদায় দেওয়ার নিয়ত রাখেনি, তাকে ধোঁকা দিয়েছে, অতঃপর স্ত্রীর হক আদায় না করেই মারা গেছে, সে ব্যক্তি কিয়ামাতের দিন ব্যভিচারী হয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করবে…’ (ত্বাবারানী, সহীহ তারগীব/১৮০৭)। তিনি আরো বলেন, আল্লাহর নিকট সবচাইতে বড় পাপিষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কোন মহিলাকে বিবাহ করে, অতঃপর তার নিকট থেকে মজা লুটে নিয়ে তাকে তালাক দেয় এবং তার মোহরও আত্মসাত করে…’ (হাকেম, বাইহাকী, সহীহুল জামে’/১৫৬৭)।

 সমাজে যেভাবে পণ প্রথা জায়গা করে নিয়েছে তা থেকে ১০০% মুক্তি পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ, মানুষ এটাকে অত্যাবশ্যকীয় ভাবেই মেনে নিয়েছে। অনেকে এমনও মনে করে যে, পণ না দিলে মেয়ে সুখী থাকবেনা। পণ দিলে শ্বশুর বাড়ির সবাই মেয়ের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। ব্যাপারটা হাস্যকর! যারা পণ না পেলে অশান্তি করবে তারা কী পণ পেয়ে ভালো ব্যবহার করার মানুষ?!! ওদের মতো অমানুষদের কাছে কী কখনও ভালো ব্যবহার আশা করা যায়?! এই সামাজিক ব্যাধি এতটাই কঠিন যে, কয়েকজন ভালো মানুষ দিয়ে তা বন্ধ করা সম্ভব নয়। যেখানে আইনের সাহায্যে তা বন্ধ হচ্ছেনা সেখানে কয়েকজন লোক কীই বা করতে পারে। তাহলে আমরা কী মুখ বুজে সব সহ্য করব? জ্বী নাহ! আমরা যেখানে যেমন করতে পারবো তা করব। যতটা আমাদের সামর্থ্যে আমরা পারব, করব।

 বিশ্বনবী সা. তো আমাদের বাতলে দিয়েছেন –“তোমাদের মধ্যে কেউ কোন অন্যায় দেখলে তা সে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে, যদি তা সম্ভব না হয় তবে মুখ দ্বারা প্রতিহত করবে, তাও যদি না করতে পারে তাহলে অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করবে। আর এ হচ্ছে (অন্তর দিয়ে প্রতিহত করা) দুর্বলতম ঈমান।”[মুসলিম: ৪৯] আমরা যদি হাত দিয়ে না আটকাতে পারি, মুখ দিয়ে না প্রতিবাদ করতে পারি কমপক্ষে অন্তর দিয়ে ঘৃণা তো করতে পারবো। গত জুম্মায় ইমাম সাহেব খুতবায় বলেন, তিনি নাকি যে বিয়েতে পণ দেওয়া নেওয়া হয় সেখানে যান না। সবাই জানে তাই তাকে আর কেউ ডাকেও না। আমরা কী এমন করতে পারিনা?! পণ প্রথার বিরুদ্ধে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করতে পারিনা?!

 আর আমরা যারা নিজেদের মুসলিম বলে বিশ্বাস করি, আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে চাই, মুহাম্মাদ সা. কে অনুসরণ অনুকরণ করি; আমাদের উচিত নিজেদের এবং পরিবারের কারও বিয়েতে পণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। আল্লাহর বিচারকে মেনে নেওয়া। মহান আল্লাহ বলেন – ‘তবে কি তারা প্রাক-ইসলামী যুগের বিচার ব্যবস্থা পেতে চায়? খাঁটি বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিচারে আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর?’ [সুরা মায়েদা/৫০]

About সম্পাদক

সম্পাদক - ইসলামের আলো
This entry was posted in অধিকারীর অধিকার, ইসলাম ও নারী, ইসলাম ও পরিবার, উদ্যোগ, উপদেশ, বিবাহ, যৌতুক, সুখী জীবন and tagged , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান